আওয়ামী লীগের বিশেষ বর্ধিত সভায় এমপিদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ ঝাড়লেন দলের তৃণমূল নেতারা। জনপ্রতিনিধিরা নেতাকর্মীদের খোঁজখবর নেন না-এমন অভিযোগ করে রোববার গণভবনে অনুষ্ঠিত বর্ধিত সভায় তৃণমূল নেতারা বলেন, এর জন্য নির্বাচনে খেসারত দিতে হতে পারে। কারণ, অবহেলা ও উপেক্ষার শিকার হয়ে আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকর্মী নিজেদের গুটিয়ে রেখেছেন। তাই আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়নের ক্ষেত্রে ছাত্রলীগের সাবেক নেতাদের প্রাধান্য দেওয়ার দাবি করেন তারা। বিশেষ বর্ধিত সভায় অভিযোগ করা হয়, দলীয় কোন্দলের কারণে অনেক মায়ের কোল খালি হচ্ছে। অবশ্য আওয়ামী লীগের সাড়ে ১৪ বছরের শাসনামলে দেশের ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে দাবি করে তৃণমূল নেতারা সংসদ নির্বাচনে আবারও নৌকা জয়ী হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন। এজন্য দলীয় ঐক্য প্রয়োজন বলে মনে করেন তারা। এ অবস্থায় দেশের প্রয়োজনে নেতারা ভেদাভেদ ভুলে সংসদ নির্বাচনে দলকে বিজয় উপহার দেওয়ার অঙ্গীকার করেন। বৈঠক সূত্র যুগান্তরকে এসব তথ্য জানিয়েছে।
জানা গেছে, আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নৌকাকে বিজয়ী না করতে পারলে দেশে ২০০১ সালের নির্বাচন-পরবর্তী সহিংসতার আশঙ্কা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, আপনারা জানেন ওই সময় কী হয়েছিল। আগামীতে আওয়ামী লীগ যদি ক্ষমতায় আসতে না পারে তাহলে সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটবে। আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের পিঠের চামড়া থাকবে না। বিএনপি-জামায়াতের মামলা-হামলা ও নির্যাতন অতীতের চেয়ে আরও বাড়বে। তিনি নির্বাচনে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার আহ্বান জানিয়ে যেসব জেলা ও মহানগর শাখা আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদক ‘ভারপ্রাপ্ত’ রয়েছেন-তাদের ভারমুক্ত করার ঘোষণা দেন।
গণভবনে সকাল সাড়ে ১০টা থেকে বিকাল সোয়া ৫টা পর্যন্ত অনুষ্ঠিত এ বিশেষ বর্ধিত সভায় জেলা-উপজেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের ৪০ জনেরও বেশি নেতা বক্তৃতা করেন। তাদের অনেকের মুখ থেকে যেমন বেরিয়ে আসে দলীয় এমপিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তেমনি বিএনপির একদফা আন্দোলন রুখে দেওয়ার অঙ্গীকারও করেন তারা। নেতারা বলেন, আমাদেরও একদফা আছে, সেটা হলো সংবিধান মেনে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনেই সংসদ নির্বাচন। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার বিকল্প কোনোভাবেই তৃণমূল আওয়ামী লীগ মেনে নেবে না। ৬ ঘণ্টার মধ্যে ১ ঘণ্টার বিরতি দিয়ে ৫ ঘণ্টাই তৃণমূল নেতাকর্মীদের বক্তব্য শোনেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
বর্ধিত সভার শুরুতে পটুয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি কাজী আলমগীর বলেন, আগামী নির্বাচনে তাকেই মনোনয়ন দেন-যে ছাত্রলীগ থেকে আওয়ামী লীগ নেতা হয়েছে। জন্মলগ্ন থেকে সুখে-দুঃখে ঝড়-বৃষ্টিতে যেসব কর্মী আপনার তৃণমূল আওয়ামী লীগকে সুসংগঠিত করে রেখেছেন। তিনি বলেন, দলের ওয়ার্ড-ইউনিয়নের তৃণমূল নেতাকর্মীরা ঝড়-বৃষ্টিতে ভিজে নৌকায় ভোট সংগ্রহ করে দেয়। তাদের ভোট ও পরিশ্রমের কারণেই আওয়ামী লীগ আজ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায়। তার নিজের জেলায় তৃণমূল নেতাকর্মীরা ভালো নেই জানিয়ে এই নেতা বলেন, মাননীয় নেত্রী আপনি আমাকে এই জেলার সভাপতি নির্বাচিত করার পরে ৭৭ ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন হয়েছে। প্রতিটা নির্বাচনে আমি নৌকাকে বিজয়ী করার জন্য মাঠপর্যায় কাজ করেছি। এমপি ও জনপ্রতিনিধিরা যে জিনিসগুলো দিয়ে তৃণমূল নেতাকর্মীদের খুশি করবেন সেই জায়গায় আওয়ামী লীগ অনুপস্থিত। উপস্থিত নেতাকর্মীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, কি বলেন ভাইয়েরা কথা সত্য নাকি মিথ্যা? এ সময় অনেকেই চিৎকার দিয়ে বলেন, ‘ঠিক’।
কাজী আলমগীর আরও বলেন, আমরা এখানে একটা উপজেলা নিয়ে ভালো নেই। সেটা হলো বাউফল। আপনি জানেন, অনেক আগে থেকে একটা বিরোধ চলছে। সেখানে অনেক মায়ের কোল খালি হয়েছে। আমি আমার নেতা ওবায়দুল কাদের ভাইকে বলব-হাতে এখনো সময় আছে আপনি বাউফলের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদককে ডাকেন। আমরাও উপস্থিত থাকব। তাদের সমস্যা কী? কেন আমরা বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে নিজেরা হাতাহাতি-মারামারি করব। সরকারের ভাবমূর্তি কোথায় থাকে? এই একটা জায়গা নিয়ে আমি খুব কষ্টে আছি। ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পনিরুজ্জান তরুণ বলেন, ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগ আজ অনেক বেশি শক্তিশালী। কোনো অশুভ শক্তিই ষড়যন্ত্র করে সফল হতে পারবে না। আমরা রাজপথে থেকে সব ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করব।
পঞ্চগড় জেলায় উন্নয়নের চিত্র তুলে ধরে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার সাদাত সম্রাট প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানান। বিএনপির এক নেতার বক্তব্য তুলে ধরে তিনি বলেন, উপকারভোগী বিএনপি নেতারাও ব্যক্তিগত আলাপে বলেন, দেশ চালানোর জন্য শেখ হাসিনার বিকল্প নেই। তাদেরকে যখন জিজ্ঞাসা করা হয়-বিএনপি নেতারা কেন সরকার ও শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আন্দোলন করেন? সমালোচনা করেন? তারা তখন জবাব দেন, মঞ্চে উঠে বক্তৃতা করে মাইকে সরকারের সমালোচনা আর বিপক্ষে না বললে-বিএনপির তো রাজনীতি থাকে না, অস্তিত্ব থাকে না। তাই তারা সরকারকে গালাগাল করেন। তবে উপকারভোগী বিএনপি নেতাকর্মীরা আগামীতে নৌকায় ভোট দেবেন বলেও জানান সম্রাট।
দিনাজপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আলতাফুজ্জামান মিতা বলেন, দিনাজপুরের একজন সংসদ-সদস্য জেলা আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে বক্তব্য দিয়ে আসছেন। তিনি দলীয় শৃঙ্খলা মানেন না।
জামালপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বিজন কুমার দাস আগামীতে চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকায় জনপ্রিয়দের অগ্রাধিকার দেওয়ার অনুরোধ জানান। নির্বাচনের আগেই জেলার সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনগুলোর মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি দেওয়ার অনুরোধ করেন তিনি। কুমিল্লা উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি রুহুল আমিন জরিপের ভিত্তিতে জনপ্রিয়দের মনোনয়ন দেওয়ার দাবি জানান। লালমনিরহাট জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট মতিয়ার রহমান লালমনিরহাটে আগামীতে দলের ভেতর থেকে মনোনয়ন দেওয়ার দাবি জানান।
ফেনী জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সংসদ-সদস্য নিজাম হাজারী বলেন, ফেনী এখন আর বিএনপির ঘাঁটি নেই। বিএনপির যে কোনো আন্দোলন শক্তহাতে দমন করা হবে। বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট তালুকদার মোহাম্মদ ইউনুস বলেন, অনেকেরই এমপি হওয়ার স্বপ্ন থাকতে পারে। সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ হলো আমাদেরকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে।
সিরাজগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুস সামাদ তালুকদার দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনার উদ্দেশে বলেন, আওয়ামী লীগ নেতা ও জনপ্রতিনিধিরা আজকে আপনার সামনে কমিটমেন্ট করে যাবেন যে, আমরা দলের ভেতরে কোনো বিভাজন করব না। নেতাকর্মীদের সঙ্গে সম্পর্ক বাড়াব। তিনি বলেন, এখান থেকে বের হয়ে দলবল নিয়ে গিয়ে এলাকায় গ্রুপিং করব-এটা যেন না হয়।
কুমিল্লা উত্তর আওয়ামী লীগের সভাপতি রুহুল আমিন বলেন, আমার জেলায় ৫ জন এমপি আছেন। তাদের ব্যাপারে খোঁজখবর নেন। এমপিরা স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে মিলেমিশে কাজ করেন না। নেত্রী, আপনাকে দেশের ৮০ ভাগ লোক ভোট দিতে চায়। আপনার প্রতীক নিয়ে তারা ভোট করে কিন্তু দলীয় নেতাকর্মীদের অনেক অভিযোগ আমরা শুনতে পাই। আমাদের ক্ষমতা দিন, যেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারি।
কিশোরগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি জিল্লুর রহমান বলেন, আমরা ভাই লীগ-বোন লীগ করি। এগুলো বন্ধ করতে হবে। ইদানীং অনেক ভোট হয়েছে, সেখানে ভোটার উপস্থিতি অনেক কম। ঢাকার মতো জায়গায় কেন এত কম ভোট পড়বে। গুলশান-বনানীতে শিক্ষিত লোক বসবাস করেন। তারা কেন হিরো আলমকে ভোট দেবেন? কারণ, আওয়ামী লীগের লোকজন ভোটকেন্দ্রে যান না। কেন যান না সেটা খুঁজে বের করতে হবে।
নরসিংদী জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি জিএম তালেব হোসেন বলেন, নেত্রী আপনি যাকে খুশি মনোনয়ন দিন। আমরা বিজয়ী করব। তবে একটা দাবি, তৃণমূলের সঙ্গে যাদের যোগাযোগ নেই-তাদের মনোনয়ন দেবেন না।
নোয়াখালী আওয়ামী লীগের সভাপতি খায়রুল হক সেলিম বলেন, নেত্রী আপনি বলছেন, শতফুল ফুটতে দিন। শতফুল তো ফুটতেই দেয় না, কেটে ফেলা হয়। কেউ যেন এই ফুল কেটে ফেলতে না পারে সে ব্যাপারে সজাগ থাকবেন। যারা দলীয় মনোনয়ন নিয়ে এমপি হন, তারা যেন একটু সংযত থাকেন-সে ব্যবস্থা করবেন।
কোটচাঁদপুর উপজেলা আওয়ামী লীগ নেত্রী বলেন, উপজেলা চেয়ারম্যানদের ক্ষমতা একেবারে কম। নেত্রী আপনি একটু নজর দিন। আমরা নির্বাচিত হয়েছি, কিন্তু সেভাবে জনগণের জন্য কাজ করতে পারি না।
হবিগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আলমগীর চৌধুরী আগামী নির্বাচনে ছাত্রলীগ থেকে উঠে আসা নেতাদের দলীয় মনোনয়ন দেওয়ার দাবি জানান। পাশাপাশি দলের কাজে লাগানোর দাবি করেন। চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের নেতা মাহাতাব উদ্দিন বলেন, শেখ হাসিনার বাইরে কোনো নির্বাচন আমরা তৃণমূল আওয়ামী লীগ মানব না।
বরগুনার তালতলী উপজেলা আওয়ামী লীগের রেজাউল কবির রিজভী বলেন, তৃণমূলের অন্তর্কোন্দলের কারণে খুবই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। যাদের মনোনয়ন দেন, এমপি হওয়ার পর তারা তৃণমূলের খোঁজখবর রাখেন না। ইউপি নির্বাচনে যারা বিদ্রোহী প্রার্থীর পক্ষে কাজ করেছে তাদের দলীয় মনোনয়ন দেবেন না। যারা তৃণমূল নেতাকর্মীর মনের ভাষা বোঝেন না, তাদের আর নৌকা দেবেন না।
যশোর জেলা আওয়ামী লীগের নেতা শহিদুল ইসলাম মিলন বলেন, আওয়ামী লীগ আজ দুইভাগে বিভক্ত। একভাগ হচ্ছে, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, আরেক ভাগ হচ্ছে ‘আমি লীগ’। আপনি মনোনয়ন দিয়ে এমপি-উপজেলা চেয়ারম্যান-মেয়র বানান। আর তারা আওয়ামী লীগ বাদ দিয়ে ‘আমি লীগ’ করে। তারা টিআর-কাবিখা কোথায় দেন, কাকে দেন দল জানে না। আওয়ামী লীগের দুর্দিনের লোকের টাকা নেই। তাই চাকরি হয় না। অথচ জামায়াত-বিএনপির লোকেরা চাকরি পায়। কারণ, তারা টাকা দেয়। এর বিহিত করা উচিত।
বগুড়া জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মজিবুর রহমান মজনু বলেন, অরাজনৈতিক ব্যক্তিরা এমপি হওয়ায় তারা অগ্নিসন্ত্রাসের মদদদাতাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয়। এদেরকে বিতাড়িত করতে হবে। রাজনীতি করা, ছাত্রলীগের সাবেক নেতাদের মনোনয়ন দিতে হবে।
পিরোজপুর জেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক কানাই লাল বক্তৃতার শেষে তাকে ভারমুক্ত করার দাবি জানান দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনার কাছে। আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, এই সভা থেকে তোমাকে ভারমুক্ত করলাম। আর কেউ ভারপ্রাপ্ত থাকবে না। সবাইকে ভারমুক্ত করা হলো-কি আপনারা (তৃণমূল থেকে আসা নেতাকর্মীরা) অনুমতি দিলেন তো? উত্তরে নেতারা দুই হাত তুলে ‘হ্যাঁ’ বলেন।