শনিবার , ৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ , রাত ১০:০৬


দুদকের ‘নির্দোষ সনদ’পেতে তৎপর অভিযুক্ত এমপিরা

রিপোর্টার : বঙ্গ পত্রিকা প্রতিবেদক
প্রকাশ : সোমবার , ১০ জুলাই ২০২৩ , রাত ০৮:২৮
প্রিন্ট ভিউ

নির্বাচনের আগে দুর্নীতি দমন কমিশন(দুদক)থেকে‘নির্দোষ সনদ’পেতে দৌড়ঝাঁপ করছেন বর্তমান ও সাবেক কয়েকজন এমপি।‘স্বচ্ছ ভাবমূর্তি’প্রমাণে ভোটের আগে দুর্নীতির অভিযোগ থেকে মুক্ত হতে তদবির করছেন।যদিও দুদক বলছে,কোনো চাপ নেই।আইন ও বিধি অনুযায়ী সবকিছু হয়।

গত দেড় বছরে বর্তমান ও সাবেক আট এমপিকে ‘নির্দোষ সনদ’হিসেবে পরিচিত পরিসমাপ্তিকরণ চিঠি তথা অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দিয়েছে দুদক।অনুসন্ধান চলমান রয়েছে বর্তমান ছয় এবং সাবেক আট এমপির বিরুদ্ধে।

দুদক সূত্রের খবর,তাদের কয়েকজন চেষ্টা করেছেন নির্দোষ সনদ পেতে।তাদের বিরুদ্ধে জমা পড়া অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণে দুদককে বোঝানোর চেষ্টা করছেন;নানা নথিপত্র দিচ্ছেন।তারা কেউ কেউ বলছেন,প্রতিহিংসাবশত তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয়েছে।কারও দাবি রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা অভিযোগ দিয়েছে,সমাজে তাদের হেয় করতে।

দুদকের একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন,বর্তমান ও সাবেক এমপিদের কেউ কেউ সরাসরি যোগাযোগ করছেন।দুদকের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সাক্ষাতের চেষ্টা করছেন।প্রভাবশালী রাজনীতিকদের মাধ্যমে চাপ দিচ্ছেন।ভিন্ন চিত্রও রয়েছে,রাজনীতির বাইরের প্রভাবশালীদের দিয়েও তদবির চলছে।

অভিযোগ থেকে রেহাই পেতে তদবির করা কয়েকজনের নাম জানিয়েছে দুদক সূত্রটি।তবে এ বিষয়ে দালিলিক প্রমাণ নেই।সূত্রটি জানিয়েছে,সুনামগঞ্জ-১ আসনের এমপি মোয়াজ্জেম হোসেন রতন,ভোলা-৩ আসনের নুরুন্নবী চৌধুরী শাওন,বরিশাল-৪ আসনের পংকজ দেবনাথ, রাজশাহী-১ আসনের ওমর ফারুক চৌধুরী,মুন্সীগঞ্জ-১ আসনে বিকল্পধারার মাহী বি চৌধুরী এবং মাদারীপুর-৩ আসনের এমপি মো.আবদুস সোবহান মিয়া গোলাপের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের অনুসন্ধান চলছে।এ তালিকায় রয়েছেন আট সাবেক এমপি।

দুদক সচিব মো.মাহবুব হোসেন রোববার বলেন,‘জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে অভিযুক্ত কোনো এমপিকে অব্যাহতি দেওয়ার ব্যাপারে দুদকের ওপর চাপ নেই,তদবিরও নেই।দুদক সবসময় আইন ও বিধি অনুযায়ী যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালনা করে।’

দুর্নীতি,চাঁদাবাজি,ঘুষ,সরকারি সম্পত্তি দখল,ক্ষমতার অপব্যবহারসহ নানা বিষয়ে অনেকের বিরুদ্ধে দুদকে অভিযোগ আসে।তা আমলে নিয়ে প্রাথমিক অনুসন্ধান শুরু হয়।অনুসন্ধানে কারও বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির তথ্য-প্রমাণ না মিললে তাঁকে পরিসমাপ্তিকরণ চিঠি দেওয়া হয়,যা নির্দোষ সনদ নামে পরিচিতি পেয়েছে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন,মনোনয়ন পেতে এবং ভোটে জিততে‘স্বচ্ছ ভাবমূর্তি’প্রয়োজন।তাই নির্বাচনের আগে নির্দোষ সনদ চান নেতারা।

অব্যাহতি পেয়েছেন যারাঃ

দুদক থেকে গত ১২ জুন নির্দোষ সনদ পেয়েছেন নারায়ণগঞ্জ-২ আসনে আওয়ামী লীগের এমপি নজরুল ইসলাম বাবু।দুদক সচিব স্বাক্ষরিত অব্যাহতিপত্রটি নজরুল ইসলামের ঢাকার গুলশানের বাসায় পাঠানো হয়।অনুলিপি দেওয়া হয় মন্ত্রিপরিষদ সচিব,জাতীয় সংসদের সিনিয়র সচিবসহ সংশ্লিষ্টদের।

এর আগে নির্দোষ সনদ পান জাতীয় সংসদের হুইপ ও চট্টগ্রাম-১২ আসনের এমপি শামসুল হক চৌধুরী,চট্টগ্রাম-৩ আসনের এমপি মাহফুজুর রহমান মিতা,ভোলা-৪ আসনের এমপি আবদুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকব, কিশোরগঞ্জ-৫ আসনের এমপি আফজাল হোসেন ও শেরপুর-১ আসনের সংসদ সদস্য আতিউর রহমান আতিক।দুই সাবেক এমপি বি এম মোজাম্মেল হক ও সিরাজুল ইসলাম মোল্লাও নির্দোষ সনদ পেয়েছেন।

নজরুল ইসলাম বাবুর বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল ক্ষমতার অপব্যবহার,টেন্ডারবাজি,চাঁদাবাজি,সম্পদ দখল ও দুর্নীতির মাধ্যমে তিনি ৫১৩ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন।হুইপ শামসুল হক চৌধুরীর বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল ক্ষমতার অপব্যবহার করে তিনি বাড়ি,গাড়ি,জমি,ফ্ল্যাট,প্লটসহ বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন।

আতিউর রহমান আতিকের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল নিয়োগ বাণিজ্য,টিআর-কাবিখা গম ও টাকা আত্মসাৎ এবং স্কুল-কলেজ এমপিও করিয়ে ঘুষ নেওয়ার।এ ছাড়া ক্ষমতার অপব্যবহার,অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে শতকোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ ছিল তাঁর বিরুদ্ধে।একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে একই অভিযোগ করা হয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে।তবে দুদক বলছে,অনুসন্ধানে আমলযোগ্য তথ্য-প্রমাণ না পাওয়ায় অভিযোগ থেকে তাদের অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।

নজরুল ইসলাম বাবু এমপি বলেন,‘প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে কেউ আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছে–তাতে কিছু যায় আসে না।দুর্নীতি পায়নি বলেই দুদক অব্যাহতি দিয়েছে।’তিনি বলেন,‘দুদকে আমার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ থাকার কারণ নেই।আমি ওই লাইনের লোক নই।’

অব্যাহতিপত্র নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও দুদক সচিব মো.মাহবুব হোসেন বলেন,‘অনুসন্ধান করে উত্থাপিত অভিযোগের বিষয়ে আমলযোগ্য তথ্য-প্রমাণ পাওয়া না গেলে,সংশ্লিষ্ট অনুসন্ধান কর্মকর্তারা সেই অভিযোগ পরিসমাপ্তির জন্য প্রতিবেদন জমা দেন।পরে কমিশন সেই প্রতিবেদন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখে এবং সঠিক হিসেবে গণ্য হলে তাদের অব্যাহতি দেয়।’তিনি বলেন,‘সব ধরনের অভিযোগ পরিসমাপ্তির ক্ষেত্রেই এ প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়।এ ক্ষেত্রে কোনো ব্যক্তিকে বিশেষভাবে বিবেচনা করার আইনগত সুযোগ নেই।’

আরও যাদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান চলছেঃ

বর্তমান ও সাবেক আরও বেশ কয়েকজন এমপির বিরুদ্ধে টিআর,কাবিখা কর্মসূচি বাস্তবায়নে দুর্নীতির অভিযোগও রয়েছে।কারও বিরুদ্ধে ক্যাসিনো ব্যবসা ও অর্থ পাচারের অভিযোগ রয়েছে।

ছয় বর্তমান এমপি ছাড়াও যে সাবেক আট সংসদ সদস্যের নামে থাকা অভিযোগ অনুসন্ধান চলছে,তারা হলেন– নরসিংদী-২ আসনের কামরুল আশরাফ খান পোটন,চাঁদপুর-৪ আসনের শামসুল হক ভূঁইয়া,বিএনপির রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু,দলটির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আসাদুল হাবিব দুলু,নোয়াখালী-৪ আসনের মো.শাহজাহান,আবদুল মোমিন তালুকদার খোকা,বিএনপির মো.শহিদুজ্জামান বেল্টু ও জাতীয় পার্টির এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদার।

এ সম্পর্কে দুদক সচিব বলেন,‘তথ্য-উপাত্ত ও রেকর্ডপত্র সংগ্রহ করা হচ্ছে।এই কাজ শেষে অনুসন্ধান কর্মকর্তারা প্রতিবেদন উপস্থাপন করবেন।এর পর কমিশন সেগুলো খতিয়ে দেখে সিদ্ধান্ত নেবে।এ ক্ষেত্রে আইন অনুযায়ী যাদের অভিযোগের পরিসমাপ্তি হবে,তাদের অব্যাহতিপত্র দেওয়া হবে।আর যাদের বিরুদ্ধে তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে আইন অনুযায়ী মামলা করার প্রয়োজন হবে,তাদের অবশ্যই আইনের আওতায় আনা হবে।’

দুদকে অনুসন্ধানাধীন অভিযোগ সম্পর্কে এমপি আবদুস সোবহান মিয়া গোলাপের বক্তব্য জানতে ফোন করা হলে তিনি বক্তব্য দিতে রাজি হননি।

বিএনপির রাজশাহী বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও সাবেক উপমন্ত্রী রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু সমকালকে বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে ওয়ান-ইলেভেনের সময় দুর্নীতির অভিযোগে দুদক মামলা করা হয়। পরে একই অভিযোগে আবারও মামলা দেওয়া হয়।’ উদ্দেশ্যমূলকভাবে তাঁকে হয়রানি করা হচ্ছে বলে দাবি করেন তিনি।

যা বললেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক এ বিষয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান সমকালকে বলেন, দুদক যার বিরুদ্ধে অভিযোগ অনুসন্ধান করছে তার পরিচয়,স্থান বা প্রেক্ষিত–এগুলোর ঊর্ধ্বে উঠে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে কাজটি সম্পন্ন করতে হবে। কারও প্রতি অনুকম্পা প্রদর্শন বা কারও দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে কমিশন দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যক্রম পরিচালনা করবে– এটাই মানুষের প্রত্যাশা। এর ব্যত্যয় হলে দুদকের প্রতি মানুষের যে আস্থার সংকট সেটি আরও ঘনীভূত হবে। তিনি বলেন, নির্বাচনের আগে বা পরে কোনো রাজনৈতিক প্রেক্ষিত বা অন্য কোনো ক্ষেত্রে প্রভাবিত হয়ে দুদক কোনো কাজ করতে পারে না।